স্বাস্থ্যোজ্জ্বল চুল আমাদের সবার কাম্য। কিন্তু  এই স্বাস্থ্যজ্বল চুল অনেকসময় অধরা থেকে যায় খুশকির কারণে। খুশকি নিয়ে আমরা সবাই কম-বেশি সমস্যায় ভুগি।  নানান জনের কাছে খুশকি দূর করার উপায় খুজি। আমাদের এই লেখাটি খুশকি দূর করার উপায় নিয়ে। 

খুশকি দূর করার উপায়

খুশকি দূর করার উপায়গুলোর মধ্যে অন্যতম হল- ১) ঘরোয়া উপায়ে খুশকি দূর করা ২) কসমেটিকস পন্যের ব্যবহারের মাধ্যমে খুশকি দূর করা।

খুশকি দূর করার ঘরোয়া উপায়-

প্রাকৃতিক উপায়গুলোর সবচেয়ে আরামদায়ক দিকটি হলো, এর প্রয়োগের ফলে কোনো ক্ষতি বা সাইড এফেক্টের সম্ভাবনা নেই। তাহলে চলুন তাড়াতাড়ি জেনে নিই খুশকি  দূর করার কি কি ঘরোয়া উপায় রয়েছে।

১. নারিকেল তেল: নারিকেল তেল স্ক্যাল্পের হাইড্রেশন বৃদ্ধি করে, চুলকানি কমায় এবং স্ক্যাল্পে ফাংগাল গ্রোথকে বাঁধা দেয়। তিন থেকে পাঁচ চামচ হালকা গরম নারিকেল তেল চুলে খুব ভালোভাবে মাসাজ করুন। এক ঘন্টা পর শ্যাম্পু দিয়ে ভালোভাবে চুল ধুয়ে ফেলুন।

২. এ্যালোভেরা: এলোভেরাতে এমাইনো এসিড, এন্টিঅক্সিডেন্টের মতো অসংখ্য বায়ো-এ্যাক্টিভ কম্পাউন্ড থাকে যা খুশকি দূর করতে খুবই চমৎকার ভূমিকা রাখে।

এলোভেরা স্ক্যাল্পের ময়েশ্চার ধরে রাখার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি কতে এবং ক্ষত সারাতেও কাজে দেয়।

ড্যানড্রাফের কারণে যেই ইনফ্লেমেশন এবং চুলকানি হয় তাও দূর করে। চুলে ধোয়ার পূর্বে সামান্য একটু এ্যালোভেরা নিয়ে ভালোভাবে চুলের গোড়ায় ঘষে মাসাজ করুন।

৩. এ্যাপল সাইডার ভিনেগার: এ্যাপল সাইডার ভিনেগারকে ড্যান্ড্রাফ দূর করার সবচেয়ে কার্যকরী উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

কোয়ার্টার কাপ ভিনেগারের সাথে সমপরিমাণ পানি মিশিয়ে রেখে দিন, চুল শ্যাম্পু করার পর আঙুল দিয়ে হালকাভাবে পুরো স্ক্যাল্পে ছড়িয়ে দিন। স্ক্যাল্পে ঘষবেন না।

১৫ মিনিট পর ভালোভাবে পানি দিয়ে চুল ধুয়ে নিন। আপনি প্রত্যেকবার শ্যাম্পু করার পরই এটি এপ্লাই করতে পারেন। তবে প্রতিদিন ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। দুইদিন পর পর ব্যবহার করলেই সর্বোচ্চ ফলাফল পাওয়া সম্ভব।

৪. এস্পিরিন: এস্পিরিনে স্যালিসাইলিক এসিড রয়েছে যা বিভিন্ন ড্যান্ড্রাফ শ্যাম্পুতে ব্যবহার করা হয়।  এটি অতিরিক্ত সেল প্রোডাকশন বন্ধ করে, অয়েল প্রোডাকশন কন্ট্রোল করে, সেই সাথে ইনফ্লেমেশন আর চুলকানিও দূর করে।

দুটো এস্পিরিন গুড়ো করে তা শ্যাম্পুর সাথে মিশিয়ে চুলে ব্যবহার করতে পারেন। ২ মিনিট পর পানি দিয়ে ভালোভাবে চুল ধুয়ে নিন।

৫. বেকিং সোডা: সোডিয়াম বাইকার্বোনেট, যা বেশিরভাগ মানুষই বেকিং সোডা বলে চেনেন – খুশকি দূর করতে দুর্দান্ত ভূমিকা রাখে। এতে এন্টিফাংগাল প্রোপার্টিজ রয়েছে যা খুশকি উৎপাদনকারী ফাংগাস দূর করতে সাহায্য করে।

তবে বেকিং সোডার পিএইচ লেভেল খুবই হাই, তাই এর বেশি ব্যবহারে স্ক্যাল্প ড্যামেজড হয়ে যেতে পারে। এর অধিক ব্যবহার স্ক্যাল্পের ন্যাচারাল অয়েল দূর করে ফেলতে পারে। তাই খুবই সামান্য পরিমাণে ব্যবহার করতে হবে। ভেজা অবস্থায় স্ক্যাল্পে সামান্য পরিমাণ বেকিং সোডা এপ্লাই করতে পারেন। কিছুক্ষণ পর ভালোভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে নিন।

৬. লেবুর রস: ২ চা চামচ পরিমাণ লেবুর রস আপনার স্ক্যাল্পে ভালোভাবে রাব করুন। কিছুক্ষণ পর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। লেবুর রসের সাথে সামান্য পরিমাণে পানি মিশিয়েও ব্যবহার করতে পারেন।

৭. অলিভ অয়েল: রাতে ঘুমানোর আগে কুসুম গরম অলিভ অয়েল ভালোভাবে পুরো চুলে মাসাজ করে নিন। তারপর শাওয়ার ক্যাপ দিয়ে চুল ঢেকে নিন। সকালে উঠে শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন।

৮. টি-ট্রি অয়েল: টি-ট্রি অয়েল হলো একটি এসেনশিয়াল অয়েল যা Melaleuca alternifolia প্ল্যান্ট থেকে এসেছে। টি-ট্রি অয়েলে terpinen-4-ol নামক কম্পাউন্ড রয়েছে যা পাওয়ারফুল এন্টি মাইক্রোবায়াল। এর ব্যবহার স্ক্যাল্পে ফাঞ্জাই এবং ব্যাক্টেরিয়ার সমস্যার সমাধান করবে।

টি-ট্রি অয়েল সরাসরি স্ক্যাল্পে এপ্লাই করলে র‍্যাশ বা ইনফ্লেমেশন হতে পারে। তাই দুই এক ফোটা টি-ট্রি অয়েল শ্যাম্পুর সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করতে পারেন।

৯. লেমনগ্রাস অয়েল: লেমনগ্রাস অয়েলে এন্টি মাইক্রোবায়াল ও এন্টিইনফ্লেমেন্টরি প্রোপার্টিজ রয়েছে যা ড্যান্ড্রাফ দূর করতে সাহায্য করে।

টি-ট্রি অয়েলের মতো লেমনগ্রাস অয়েলও সরাসরি স্ক্যাল্পে এপ্লাই করলে ইরিটেশন বা এলার্জিক রিয়্যাকশন হতে পারে। তাই কমপ্লিকেশনস এভয়েড করতে দু এক ফোটা লেমনগ্রাস অয়েল আপনার শ্যাম্পু বা কন্ডিশনারের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করতে পারেন।

১০. Omega-3 fatty acid: ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিডের অভাবে ড্যান্ড্রাফ, নখ ভঙ্গুর বা পাতলা হওয়া, ড্রাই স্কিনের সমস্যা দেখা দেয়। এটি স্ক্যাল্পের অয়েল প্রোডাকশন নিয়ন্ত্রণ করে, ইনফ্লেমেশন দূর করে, হাইড্রেশন বাড়ায়।

স্যালমন, ম্যাকারেল, ওয়ালনাট এ প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড রয়েছে। ন্যাশনাল হেলথ ইন্সটিউশনের মতামত অনুযায়ী একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দিনে ১.১ থেকে ১.৬ গ্রাম ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড গ্রহণ করা প্রয়োজন। যেকোনো হেলথ ফুড স্টোর, ফার্মেসী বা অনলাইনেই এটি এভেইলেবল।

১১. ডিমের কুসুম: ডিমের কুসুমে বায়োটিন থাকে যা একটি মেজর ভিটামিন এবং ড্যান্ড্রাফ দূর করতে কার্যকরী। এছাড়াও ডিমের কুসুম চুলকে ডিপ কন্ডিশনিং করে আর চুলকে করে তোলে হেলদি, মসৃণ এবং উজ্জ্বল। স্ক্যাল্প এবং চুল শুকনো অবস্থায় ডিমের কুসুম পুরো স্ক্যাল্পে মাসাজ করতে হবে।

তারপর একটি শাওয়ার ক্যাপ দিয়ে চুল ঢেকে ঘন্টাখানেকের জন্য অপেক্ষা করুন। ঘন্টাখানেক পর শ্যাম্পু দিয়ে ভালোভাবে চুল ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার এই পদ্ধতি অনুসরণ করলেই ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।

১৩. গ্রিন টি: সবচেয়ে শর্টকাট পদ্ধতি হলো গ্রিন টি এর ব্যবহার। গ্রিন টি তে অনেক বেশি পরিমাণে এন্টি ফাংগাল প্রোপার্টিজ ও এন্টি অক্সিডেন্ট থাকে যা স্ক্যাল্পের হেলথ রিস্টোর করতে সাহায্য করে।

ড্যান্ড্রাফের সমস্যা দূর করতে প্রথমেই ২টি গ্রিন টি এর টি ব্যাগ গরম পানিতে ডুবিয়ে রাখুন। এর সম্পূর্ণ নির্যাস টুকু বের হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।

পানিটাকে পুরোপুরি ঠান্ডা হতে দিন। ঠান্ডা হওয়ার পর তা আপনার স্ক্যাল্পে আলতোভাবে মাসাজ করে নিন। ৩০ মিনিট পর চুল পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিন খুশকি দূর করার জন্য।

 

১৪. কলা: কলাতে ভিটামিন বি থাকে যা ব্লাড সার্কুলেশন বাড়াতে সাহায্য করে এবং ত্বক হেলদি রাখে। কলার সাথে এ্যাপল সাইডার ভিনেগার মিশিয়ে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

দুচামচ এ্যাপল সাইডার ভিনেগার এবং একটি কলা একসাথে মিশিয়ে ভালোভাবে পেস্ট করে নিন। এই পেস্ট আপনার পুরো স্ক্যাল্পে ধীরে ধীরে এপ্লাই  করুন।

খেয়াল রাখবেন যেনো পুরো স্ক্যাল্পে কভার করে। ২০ মিনিট পর নরমাল পানি বা শ্যাম্পু ইউজ করে চুল ধুয়ে নিন।

১৫. রসুন: রসুন হচ্ছে এন্টিফাংগাল প্রোপার্টিজ এর একটি ভালো উৎস যা ড্যান্ড্রাফ সহ অন্যান্য ক্ষতিকর মাইক্রোবকে ধ্বংস করে। দুই তিন কোয়া রসুন সামান্য মধুর সাথে মিশিয়ে পেস্ট করেন নিন। এটি পুরো স্ক্যাল্পে এপ্লাই করুন। ১৫/২০ মিনিট পর পানি দিয়ে ভালোভাবে চুল ধুয়ে ফেলুন।

এছাড়াও মেহেদী পাতা, নিমপাতা, মেথি, কমলার খোসা, টকদই ইত্যাদিও ঘরোয়া উপায়ে খুশকি দূর করার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে

কসমেটিকস পন্যের ব্যবহার-

যদি ঘরোয়া ট্রিটমেন্টে খুশকি দূর না হয় সেক্ষেত্রে কিছু মেডিকেটেড শ্যাম্পু ব্যবহার করে ভালো ফলাফল পেতে পারেন। সব ড্যান্ড্রাফ শ্যাম্পুতে একই উপাদান থাকে না। চলুন দেখে নিই কোন কোন   গুলো ড্যান্ড্রাফ দূর করতে সাহায্য করে।

1.কোল টার: এতে প্রাকৃতিক এন্টিফাংগাল এজেন্ট রয়েছে। এটি অতিরিক্ত ত্বকের সেল জন্মানো  কমায়। 

2. পাইরিথিওন জিংক: ইস্টের বৃদ্ধি ব্যাহত করে।

3. স্যালিসাইলিক এসিড এবং সালফার 

4. স্যালিসাইলিক এসিড: অতিরিক্ত ত্বকের কোষ জন্মানো কমায়।

5. সেলেনিয়াম সালফাইড: এতে এন্টিফাংগাল প্রোপার্টিজ রয়েছে। এটি স্ক্যাল্প গ্ল্যান্ডগুলোর অতিরিক্ত তেল নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে। 

6. কিটোকোনাজল: এটি একটি এন্টিফাংগাল উপাদান যা যেকোনো বয়সের মানুষের জন্যই কার্যকর।

অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে একটা শ্যাম্পু প্রথমে খুবই ভালোভাবে কাজ করছে কিন্তু কিছুদিন পর তা আর আগের মতো কাজ করছে না। এক্ষেত্রে আপনি অন্য শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারেন।

কোল টার সমৃদ্ধ কোনো শ্যাম্পু ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে চুলের যত্নে একটু বেশি মনোযোগ দিতে হবে। 

সেই সাথে নিচের কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে- 

১. কিছু লোকের এতে অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে

২. এটি চুল, নখ, ত্বক এবং কাপড়ের রঙ হালকা পরিবর্তন করতে পারে।

৩. খেয়াল রাখতে হবে যেনো ত্বকের কোনো কাটাছেড়া, ইনফেকশন এবং চোখে যেনো না যায়।

৪. এটি আপনার ত্বককে সূর্যের আলোতে আরও সংবেদনশীল করে তুলতে পারে – এটি ব্যবহারের পরে আপনার ২৪ থেকে ৭২ ঘন্টা রোদ থেকে দূরে থাকতে হবে।

৫. গর্ভবতী বা শিশুদের স্তন্যদুগ্ধ দানকারী মহিলাদের এটি ব্যবহার করা উচিত নয়।

এন্টি-ডেনড্রাফ শ্যাম্পু ব্যবহার করার নিয়ম-

১. প্রথমে ভেজা চুলে খুব ভালোভাবে শ্যাম্পু রাব করুন।

২. ৫ মিনিট অথবা নির্দেশিত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।

৩. ভালোভাবে পানি দিয়ে সম্পূর্ণ শ্যাম্পু ধুয়ে ফেলুন, খেয়াল রাখবেন যেনো চুলের কোথাও শ্যাম্পু অবশিষ্ট লেগে না থাকে।