দৈনন্দিন জীবনে ব্রণ একটি আতঙ্কের নাম। সারাদিনের পরিশ্রম, ধকল ও ধুলাবালিতে লাবণ্য হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে যায় ত্বক। নিস্তেজ ত্বকে সহজেই জীবাণুর সংক্রমণ হয়, দেখা দেয় ব্রণ সহ নানা সমস্যা। কম বেশি আমরা সবাই এই ব্রণের সমস্যায় ভুগি। ব্রণ দূর করার উপায় হিসেবে আমরা নানা কিছু ব্যবহার করি। কিন্তু এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের জানতে হবে ঠিক কি কি কারণে ত্বকে ব্রণ সৃষ্টি হয় আর কি কি করলে এড়ানো যাবে এই উটকো ঝামেলাকে।
ব্রণ কি?
একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে প্রতি ৩ ঘণ্টা অন্তর অন্তর ১ মিলিগ্রাম/১০cm2 সেবাম নিঃসরণ হওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে যদি প্রতি ৩ ঘণ্টায় ১.৫ মিলিগ্রাম/১০cm2 সেবাম নিঃসরণ হয় তাহলে বলা যায় যে আমাদের ত্বক তৈলাক্ত হয়ে গেছে।
সেবেসিয়াস গ্রন্থি থেকে প্রচুর পরিমাণে তেল নিঃসরণ কারণেই লোমকূপ গুলো বড় হয়ে যায়। অনেকসময় ধুলাবালি, ময়লা, মেক-আপ আটকে লোমকূপ বন্ধ হয়ে যায়। এই বন্ধ লোমকূপে জীবাণুর বিস্তারের জন্য সবচেয়ে উপযোগী পরিবেশ।
জীবাণু গুলো বন্ধ লোমকূপের ভেতর সেবামের মধ্যে নিজেদের বংশ বিস্তার করতে শুরু করে। যার ফলেই একনি বা ব্রণ তৈরি হয়।
ঠিক ওই সময় জীবাণুর বিস্তার রোধ করতে শ্বেত রক্তকণিকা ছুটে আসে। ত্বকের ভেতরের এই বিক্রিয়াগুলোর সময় ত্বকে ইনফ্লেমেশন বা ইরিটেশনও অনুভূত হতে পারে।
ব্রণ কেন হয়?
আমাদের ত্বকের লোমকূপ বা পোর্স বন্ধ হয়ে গিয়ে যে যে সমস্যার তৈরি করে তার মধ্যে প্রধান হলো একনি বা ব্রণ। ব্রণের সমস্যার জন্য যে তিনটি মূল কারণকে দায়ী করা হয়েছে তা হলো:
১. লোমকূপ বা পোর্স বন্ধ হয়ে যাওয়া
আমাদের ত্বকে যেসব কোষ থাকে তাদের আয়ুষ্কাল হলো ২৮ দিন। ত্বকে ডার্মিস, এপিডার্মিস এবং সার্ফেস স্তর রয়েছে। ডার্মিস থেকে সেলগুলোর সার্ফেসে আসার জন্য ২৮ দিন সময় লাগে।
এভাবেই ভেতরের স্তর থেকে নতুন কোষ উপরের স্তরে আসে এবং উপরের স্তরের মৃত কোষ গুলো ঝরে পড়ে। এই প্রক্রিয়াটিকে টার্নওভার বা desquamation বলে। ব্রণপ্রবণ স্কিনে এই টার্নওভার প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে ঘটছে না।
তার পরিবর্তে সাধারণের তুলনায় আরো বেশি সেল তৈরি হচ্ছে এবং এগুলি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় ধরে স্কিনে রয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াকে রিটেনশন বা হাইপার কেরাটোসিস বলে।
এই অতিরিক্ত সেলগুলি লোমকূপ বন্ধ করে রাখে যার ফলে ব্রণসহ নানা ধরনের স্কিন প্রবলেম দেখা দেয়।
২. সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ড বা তৈলগ্রন্থি থেকে অতিরিক্ত তেল ক্ষরণ
বেশিরভাগ মানুষই ব্রণের জন্য তৈলাক্ত ত্বককে দায়ী করে থাকেন। আমাদের ত্বকের যে গ্রন্থি থেকে সেবাম বা অয়েল উৎপন্ন হয় তাকে সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ড বা তৈলগ্রন্থি বলে। এবং সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ড থেকে উৎপন্ন তেলকে সেবাম বলা হয়।
যাদের ত্বক শুষ্ক তাদের সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ড থেকে কম পরিমাণে সেবাম উৎপন্ন হয়। অপরদিকে সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ড থেকে অধিক পরিমাণে সেবাম উৎপন্ন হওয়ার কারণে ত্বক তৈলাক্ত হয়। তাহলে বুঝতেই পারছেন।
শুষ্ক বা তৈলাক্ত উভয় ধরনের ত্বকেই তেল উৎপন্ন হয়। কোনোভাবে এই সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ডের মুখ বন্ধ হয়ে গেলে ত্বকে উৎপন্ন অয়েল বাইরে বের হতে পারে না, অর্থাৎ বাঁধাপ্রাপ্ত হয়।
যে কারণে একনি বা ব্রণের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ শুষ্ক বা তৈলাক্ত সব ধরনের ত্বকেই ব্রণের সমস্যা হতে পারে।
৩. ব্রণজনিত জীবাণু গুলোর বিস্তার
ব্রণজনিত কিছু জিবাণু আমাদের লোমকূপের ভেতরে প্রবেশ করে বংশবিস্তার করে যার ফলে একনি, ব্রেক আউট, স্কিন সেন্সিটিভিটি, চুলকানি, জ্বালাপোড়া সহ নানান ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।
এই কারণগুলো হরমোনগত পরিবর্তনের দ্বারা ট্রিগার হতে পারে, যা থেকে ধারণা পাওয়া যায় কেনো আমাদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ব্রণের সমস্যার সম্মুখীন হই। যেমন: বয়ঃসন্ধি, গর্ভাবস্থা, প্রি-মেনোপজ, মেনোপজ।
৪)হরমোনের ভূমিকা
ব্রণের বিকাশে হরমোন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদের মধ্যে প্রধান হলো অ্যান্ড্রোজেন হরমোন: ইস্ট্রোজেন এবং টেস্টোস্টেরন।
অ্যান্ড্রোজেন হরমোন, বিশেষ করে টেস্টোস্টেরন সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ডকে প্রভাবিত করে এবং অতিরিক্ত তেল উৎপাদনে উৎসাহ দেয়। ধারণা করা হয় অ্যান্ড্রোজেন হরমোন ব্রণ সৃষ্টিকারী জীবানুগুলির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেয়।
ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন হরমোনও ব্রণের বিকাশের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। গর্ভাবস্থা এবং মেনোপজের সময় এই দুটি হরমোনের কারণেই ত্বকে ব্রণের দেখা দেয়।
সহজভাবে বলতে গেলে, ব্রণের জন্য দায়ী তিনটি কারণ যদি আপনার ত্বকে বিদ্যমান থাকে এবং তা যদি ব্রণ বিকাশের জন্য দায়ী হরমোনের সাথেও ম্যাচ করে যায় তাহলে আপনার ত্বকের অস্বাভাবিক ভাবে ব্রণের বিস্তার দেখা দিতে পারে।
৫)অন্যান্য সাধারণ কারণ
যদিও এই কারণগুলিকে ব্রণ তৈরির প্রাথমিক কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না তবে এই সাধারণ বিষয়গুলি আপনার ত্বকে ব্রণ তৈরি হওয়ার প্রাথমিক কারণগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে।
১. কসমেটিক্স: বাজারে এভেইলেবল নানা ধরনের ভেজাল কসমেটিক্স বা ভুল কসমেটিক্স এর ব্যবহারের কারণে ব্রণের সমস্যা দেখা দিতে পারে
২. অতিরিক্ত ঘাম বা তাপমাত্রা
৩. বিশেষ কিছু ড্রাগ/ঔষধ – জন্মনিরোধক পিল, স্টেরয়েড, এন্টি কনভালসেন্ট লিথিয়াম।
৪. এছাড়াও বংশগত বা জেনেটিক কারণে অনেকের ত্বকে ব্রণের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
যাদের ব্রণপ্রবণ ত্বক তাদের ক্ষেত্রে ব্রণের সমস্যাটা দীর্ঘস্থায়ী হয়। অর্থাৎ সময়ে সময়ে ব্রণের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। জেনেটিক কারণেও অনেকের ত্বক ব্রণপ্রবণ হয়। তাই ব্রণপ্রবণ ত্বকের ক্ষেত্রে প্রথমেই যেটা করতে হবে তা হলো একনি প্রতিরোধ করতে হবে।
ব্রণ দূর করার উপায়
ব্রন দূর করার উপায় হিসেবে আপনার স্কিন কেয়ার রুটিনে নিচের ধাপ গুলো অনুসরন করতে পারেন।
১. এক্সফোলিয়েশন
আমাদের ত্বকে যেসব কোষ থাকে তাদের আয়ুস্কাল হলো ২৮ দিন। ভেতরের স্তর থেকে নতুন কোষ উপরের স্তরে আসে এবং উপরের স্তরের মৃত কোষ গুলো ঝরে পড়ে।
এই মৃত কোষগুলো পুরোপুরি চলে না গেলে তা জমে জমে লোমকূপের মুখ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যার ফলে স্কিনে একনির সমস্যা দেখা দিতে পারে। এক্সফোলিয়েশনের মাধ্যমে ত্বকের উপরের স্তরের এই মৃত কোষ এবং ময়লা দূর হয়। যার ফলে ত্বক সুরক্ষিত থাকে।
সপ্তাহে এক থেকে দুইবার এক্সফোলিয়েট করা ব্রণ দূর করার উপায় হিসেবে ভালো কাজ করে।
২. ক্লিঞ্জিং
ত্বক ময়লা জমলে বা ত্বক অপরিষ্কার রাখার কারণেই যে শুধু ব্রণ হয় এই ধারণাটা আসলে সম্পূর্ণ সঠিক নয়। অনেক সময় হেয়ার ফলিকল অথবা লোমকূপের মুখে মৃত ত্বকের কোষ, তেল, মেক আপ রেসিডিউ জমে লোমকূপ আটকে ফেলে, যেখানে জীবাণুর বিস্তারে ব্রণ বা একনি তৈরি হয়।
ক্লিঞ্জিংয়ের মাধ্যমে আমরা আমাদের ত্বকের উপরিভাগ ও লোমকূপের গভীরে জমে থাকা ময়লা, তেল, মৃত কোষগুলিকে পরিষ্কার করি। ফলে ব্রেক আউট, পিম্পল, একনি সহ নানা ধরনের সমস্যা থেকে আমাদের ত্বক রক্ষা পায়।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর এবং রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ক্লিঞ্জিং করা জরুরী।
৩. ডায়েট
ডায়েটের সাথে ব্রণের আসলেই কোনো সম্পর্ক আছে কিনা তা নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। যদিও ডায়েটের সাথে ব্রণের সম্পর্ক নিয়ে তেমন শক্ত প্রমাণ নেই তবুও অবজারভেশনাল এভিডেন্স অনুযায়ী ধারণা করা যায়, যে খাবারগুলি আমাদের ব্লাড সুগার লেভেল বাড়িয়ে তোলে, অর্থাৎ কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার একনির ডেভেলপমেন্টে ভূমিকা রাখে।
আবার অনেকের ক্ষেত্রে ডেইরী প্রোডাক্ট গ্রহণের ফলেও একনির সমস্যার কথা শোনা যায়। যদিও এ বিষয়টিও সায়েন্টিফিকেলি প্রমাণিত নয়।
তাই গবেষণালব্ধ ফলাফল পাওয়ার আগ পর্যন্ত আপনার নিজের খেয়াল রাখতে হবে কোনো নির্দিষ্ট টাইপের খাবারের কারণে আপনার স্কিনে একনির প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে কি না অথবা একনির প্রভাব বেড়ে যাচ্ছে কিনা।
তবে আপনার খাদ্য তালিকা থেকে একটা মেজর ফুড গ্রুপ বাদ করার আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৪. স্ট্রেস রিলিফ
ডায়েটের মতোই স্ট্রেসের সাথে একনির কানেকশন নিয়ে তেমন শক্ত প্রমাণ নেই। তবে অনেক সময় অতিরিক্ত চিন্তার কারণে ব্রণের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে।
যাদের ইতোমধ্যেই ব্রণের সমস্যা রয়েছে, অতিরিক্ত চিন্তার কারণে এই সমস্যা আরো বাড়তে দেখা যায়। এটা অনেক ক্ষেত্রে মানুষের সাইকোলজির সাথে জড়িত।
যারা তুলনামূলক মানষিক শান্তির অবস্থায় থাকেন তাদের স্কিন প্রবলেম সহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যাগুলোও কম হয়।
৫. পর্যাপ্ত ঘুম
সুস্থ এবং ব্রণমুক্ত স্কিনের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম খুবই জরুরী। পর্যাপ্ত ঘুম আপনার মন, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে, বডির মেটাবলিজম ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে, সেই সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে।
একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের ২৪ ঘন্টায় অন্তত সাত থেকে আটঘন্টা ঘুমানো উচিত।
৬. পর্যাপ্ত পানি পান
পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান শুধু ব্রণই না অন্যান্য সকল স্কিন প্রবলেম, শারীরিক প্রবলেম দূরে রাখতে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান শরীরের ময়লা দূর করে। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দিনে ন্যূনতম ৭ থেকে ৮ গ্লাস পানি পান করা প্রয়োজন।