ত্বকের যত্নে আমরা যেসব প্রসাধনী ব্যবহার করি তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত প্রসাধনীটি হল – ময়েশ্চারাইজার। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে যা ক্রিম নামে সুপরিচিত।

ময়েশ্চারাইজার আমাদের ত্বককে হাইড্রেট করে, একইসঙ্গে ত্বকের হাইড্রেশনও ধরে রাখে। অর্থাৎ এটি আমাদের ত্বকের উপরিভাগে একটি প্রলেপ তৈরি করে যা দীর্ঘসময়  ব্যাপী আমাদের ত্বক থেকে পানি বের হয়ে যেতে দেয় না এবং ত্বকের ভিতরে ক্ষতিকারক জীবাণুগুলোকে প্রবেশ করতেও  দেয় না।

ময়েশ্চারাইজারের অভাব হলে আমাদের ত্বকে শুষ্কতা দেখা দেয়, ত্বকে চুলকানি হয়। অনেক সময় ত্বক লাল হয়ে যায়, জ্বালাপোড়া করে, সূচ ফোটানোর মত যন্ত্রণা হয়, ত্বকে সহজেই বয়সের বলি রেখা পরে।

আবার অনেকর ক্ষেত্রে ময়েশ্চারাইজারের অভাব হলে  ত্বকের তৈলাক্তভাব বেড়ে যায়, ফলে ত্বকে একনি, পিম্পল সহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। তাই ত্বককে সুস্থ ও সুন্দর রাখতে সব ধরণের ত্বকেই ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত।

তবে খেয়াল রাখতে হবে যে ময়েশ্চারাইজারটি যেন অবশ্যই আমাদের ত্বকের ধরন উপযোগী হয় এবং এর ব্যবহারও যেন  সঠিক নিয়মানুযায়ী হয়। তাহলে আসুন জেনে নেই কিভাবে আমরা ত্বকের ধরন অনুযায়ী সঠিক ময়েশ্চারাইজারটি বাছাই করবো।

ময়েশ্চারাইজার বাছাই

আমাদের প্রতিটি ত্বকের ধরন আলাদা। ফলে আমাদের ত্বকের চাহিদাগুলোও আলাদা। এই আলাদা আলাদা চাহিদাগুলোর কথা মাথায় রেখে বাজারে নানা ধরনের ময়েশ্চারাইজার তৈরি করা হয়েছে।

বাজারে প্রচলিত এইসব ময়েশ্চারাইজারগুলো থেকে খুব সহজেই ২টি পদ্ধতি অনুসরন করে আমরা  আমাদের ত্বক উপযোগী ময়েশ্চারাইজারটি বাছাই করতে পারি। পদ্ধতি ২ টি হল-

১। ময়েশ্চারাইজারের টাইপ বিশ্লেষণ করে

২। ময়েশ্চারাইজারের ইনগ্রিডিয়েন্টস চেক করার মধ্যে দিয়ে

ময়েশ্চারাইজারের টাইপ বিশ্লেষণ

বাজারে চার ধরণের ময়েশ্চারাইজার রয়েছে। জেল ময়েশ্চারাইজার,লোশন ময়েশ্চারাইজার, ক্রিম ময়েশ্চারাইজার, অয়েন্টমেন্ট ময়েশ্চারাইজার।

জেল ময়েশ্চারাইজারঃ

জেল ময়েশ্চারাইজার মুলত ব্যবহারই হয় তৈলাক্ত ত্বকের জন্য। কারন তৈলাক্ত ত্বকে তেলের পরিমাণটা বেশী থাকে এবং পানির পরিমাণটা কম থাকে। তাই এই ধরনের ত্বকে পানির চাহিদা খুব বেশি হয়।

আর জেল ময়েশ্চারাইজারে পানির পরিমান বেশি থাকে এবং তেলের পরিমাণ কম থাকে বা থাকে না। ফলে এটি খুব সহজেই তৈলাক্ত ত্বকে পানি ও তেলের মধ্যে ভারসাম্য নিয়ে আসতে পারে।

এটি খুব হালকা হওয়ায় খুব সহজেই আমাদের ত্বক তা শোষন করে নেয় এবং এতে ত্বকের তেল চিটচিটে ভাবটাও দূর হয়। কম্বিনেশন স্কিনের ক্ষেত্রেও এটি ব্যবহার করা যায়।   

লোশন ময়েশ্চারাইজার

এতে জেল ময়েশ্চারাইজারের তুলনায় পানির পরিমাণটা কম থাকে কিন্তু তেলের পরিমাণটা বেশি থাকে। অর্থাৎ লোশন ময়েশ্চারাইজারে পানির তুলনায় তেলের পরিমানটা  কম থাকে।

আর আমাদের শুষ্ক ত্বকে তেল ও পানি উভয়েই কম পরিমানে থাকে। এক্ষেত্রে পানিটা বেশী পরিমানে কম থাকে, আর তেলটা তুলনামুলক কম থাকে।

কাজেই আমরা বলতে পারি যে  লোশন ময়েশ্চারাইজার আমাদের শুষ্ক ত্বকের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী। এটি দেখতে ক্রিমের চেয়ে হাল্কা হয়।

ক্রিম ময়েশ্চারাইজার

জেল ও লোশন ময়েশ্চারাইজারের তুলনায় ক্রিম ময়েশ্চারাইজারে পানি আর তেলের পরিমানটা প্রায় কাছাকাছি থাকে। আর আমাদের নরমাল ত্বকের ক্ষেত্রেও  তেল আর পানির পরিমানটা  প্রায় কাছাকাছি থাকে।

কাজেই আমরা বলতে পারি যে ক্রিম ময়েশ্চারাইজারটি  নরমাল ত্বকের ক্ষেত্রে  সবচেয়ে বেশি ব্যবহার উপযোগী। তবে এর ঘনত্ব বেশি হওয়ায় অনেকেই একে শুষ্ক ত্বকের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী বলে মনে করেন।

অয়েন্টমেন্ট ময়েশ্চারাইজার

অন্য ময়েশ্চারাইজারদের তুলনায় এতে তেলের পরিমান অনেক বেশি থাকে। এটি খুবই ঘন হয়। আর তেল অনেক বেশি পরিমাণে দরকার পরে অতীব শুষ্ক ত্বকের ক্ষেত্রে।

কাজেই আমরা বলতে পারি যাদের স্কিন সুপার ড্রাই তাদের ক্ষেত্রে অয়েন্টমেন্ট ময়েশ্চারাইজারটি খুব কারজকরি।

এই প্রতিটি টাইপ ময়েশ্চারাইজার-ই আবার তাদের ফর্মুলেশনের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ত্বকের উপযোগী হয়ে উঠতে পারে। এইসব ক্ষেত্রে আমাদের ময়েশ্চারাইজার চুজ করতে হবে এর ইনগ্রিডিয়েন্টস চেক করার মধ্যে দিয়ে।

ময়েশ্চারাইজারের ইনগ্রিডিয়েন্টস চেক

একটি ময়েশ্চারাইজারে ন্যূনতম ৩ ধরনের ইনগ্রিডিয়েন্টস থাকে। তা হল-

১। হিউমেকট্যান্টসঃ

এরা মূলত ত্বকে পানি যোগান দেয়। অর্থাৎ এটি ত্বকের ডার্মিস স্তর থেকে এপিডার্মিস স্তরে ত্বকের জন্য প্রয়োজনীয় পানি নিয়ে আসে। অনেক সময় পরিবেশ থেকেও এরা  ত্বকের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করে।

কয়েকটি সুপরিচিত হিউমেকট্যান্টস হল- গ্লিসারিন, হায়ালুরনিক এসিড, প্যানথেনল, ইউরিয়া, সর্বিটল, মধু, ল্যাকটিক এসিড, প্রপিলিন গ্লাইকল, সোডিয়াম পিসিএ, সি-সল্ট ইত্যাদি।

ইমোলিয়েন্টসঃ

এরা আমাদের ত্বকে একটি স্তর তৈরি করে যেন আমাদের ত্বক থেকে পানি বের হয়ে না যেতে পারে। এরা মূলত আমাদের ত্বকে তেলের যোগান দেয়।

এরা আমদের ত্বককে নরম ও কোমল রাখে। কয়েকটি সুপরিচিত ইমোলিয়েন্টস হল- স্কোয়ালেন,ল্যানোলিন,ডেমেথিকোন,ক্যাস্টর অয়েল, শেয়া বাটার, জোজবা অয়েল ইত্যাদি।

অকক্লুসিভস

এরা আমাদের ত্বকে খুবই পুরো একটি স্তর করে যেন আমাদের ত্বক থেকে পানি কিছুতেই বের হয়ে যেতে না পারে, আবার ক্ষতিকারক কোন কিছু যেন প্রবেশ করতে না পারে।

এরা খুবই তৈলাক্ত হয়। কয়েকটি সুপরিচিত অকক্লুসিভস হল –পেট্রোলিয়াম,মিনারেল অয়েল, প্যারাফিন,সিটাইল অ্যালকোহল, বিস-অয়াক্স, টেকোফেরল ইত্যাদি।

এখন যে ময়েশ্চারাইজারে হিউমেকট্যান্টস এর পরিমাণ বেশি তা অয়েলি স্কিনের জন্য ভাল। আর যে ময়েশ্চারাইজারে ইমোলিয়েন্টস এর পরিমান বেশি তা শুষ্ক ত্বকের জন্য ভাল।

আর যে ময়েশ্চারাইজারে অকক্লুসিভস এর পরিমাণ বেশি তা অতীব শুষ্ক ত্বকের জন্য উপকারী। কম্বিনেশন স্কিনের ক্ষেত্রে শুষ্ক অংশে অয়েল বেসড ময়েশ্চারাইজার আর অয়েলি অংশে ওয়াটার- বেসড ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করার চেস্টা করুন।

আর সংবেদনশীল ত্বকের ক্ষেত্রে ক্রিত্তিম রং,গন্ধ ও ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপাদান মুক্ত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করার চেস্টা করুন।

চেস্টা করুন আপনার ময়েশ্চারাইজারটিতে ত্বকের লালচে ভাব ও জ্বালা- পোড়া দূর করতে পারে এমন উপাদান রাখতে।

ময়েশ্চারাইজার ব্যবহারের নিয়ম

 ১। ময়েশ্চারাইজারের কোন উপাদান আমাদের ত্বকে অ্যালার্জি তৈরী করছে কি না? মুখে লাগানোর পূর্বে তা নিশ্চিত হতে প্রথমেই ময়েশ্চারাইজারটির প্যাচ টেস্ট করে নিতে হবে।

অর্থাৎ সামান্য পরিমাণ ময়েশ্চারাইজার হাতের কব্জির উপর কিংবা কানের লতিতে প্রয়োগ করে মিনিমাম ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

যদি এই সময়ের মধ্যে আমদের ত্বকে কোন অ্যালার্জি,লালচে ভাব। জ্বালা-পোড়া কিংবা কোন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত না হয় তবে নিশ্চিন্তে  আমরা ময়েশ্চারাইজারটি ব্যবহার করতে পারি।

আর ন্যূনতম পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখালেও ময়েশ্চারাইজারটি আমদের ব্যবহার করা উচিৎ নয়।

২। ত্বক ভেজা থাকা অবস্থায় অর্থাৎ গোসল বা মুখ ধোয়ার পরে কিংবা মুখে পানি স্প্রে করে ময়েশ্চারাইজার লাগাতে হবে। স্বাভাবিক ত্বকে-রাতে ঘুমাবার আগে অবশ্যই ময়েশ্চারাইজার লাগাতে হবে।

এছাড়াও যেসব ক্ষেত্রে আর্দ্রতা হারানোর সম্ভবনা বেশী যেমন অতিরিক্ত রোদে গেলে,চুলা বা আগুনের পাশে গেলে।

শীতের সময়,ফ্যানের বাতাস বা এসি রুমে বেশীক্ষণ অবস্থানকালে, এসব ক্ষেত্রেও স্বাভাবিক ত্বকে ময়েশ্চারাইজার লাগাতে হবে। শুষ্ক ত্বকে- রূপচর্চার প্রধান অনুষঙ্গই ময়েশ্চারাইজার।

প্রয়োজনমত একাধিকবার প্রয়োগ করতে হবে। তবে রাতে ঘুমাবার আগে অবশ্যই লাগাতে ভুলবেন না। তৈলাক্ত ত্বকে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করলে ত্বকের তৈলাক্তভাব অনেকটাই কমে যায়। চেস্টা করুন অন্তত দুইবার ময়েশ্চারাইজার লাগাতে।

৩।আজকাল সানস্ক্রীন ও ময়েশ্চারাইজার একসাথেই পাওয়া যায়।দিনের বেলায় ব্যবহারের জন্য কমপক্ষে ১৫ এসপিএফ যুক্ত ময়েশ্চারাইজার বেশ উপযোগী।

৪। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহারের কারণে ত্বক ম্যাসারেটেড(Macerated) হয়ে অতিরিক্ত নরম ও সাদা হয়ে যেতে পারে যা ত্বকের জন্য মোটেই স্বাস্থ্যকর নয় এবং জীবাণু  সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।